ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘকালীন বৈরিতা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিকে স্থায়ী অনিশ্চয়তায় রেখেছে। এই উত্তেজনার প্রতিটি পর্যায়ে, দৃশ্যপটের আড়ালে থেকেও এক বিশাল কৌশলগত লাভবান খেলোয়াড় হয়ে উঠছে চীন।
বেইজিং তার অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক অবস্থান এমনভাবে শক্তিশালী করছে—যা শুধু ভারত ও পাকিস্তানের পারস্পরিক সম্পর্ক নয়, গোটা দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের শক্তি ভারসাম্যকেই প্রভাবিত করছে।
চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ। তবে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত যত বাড়ে, ইসলামাবাদের উপর বেইজিংয়ের প্রভাব ততই গভীর হয়। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (CPEC)–এর মাধ্যমে চীন শুধু পাকিস্তানে অবকাঠামোগত বিনিয়োগ করছে না, বরং আর্থিক ও রাজনৈতিক নির্ভরতার একটি কাঠামো তৈরি করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নির্ভরতা পাকিস্তানের কূটনৈতিক স্বাধীনতা কমিয়ে চীনের কৌশলগত বলয়ে নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে যখন ইসলামাবাদ আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে, তখন বেইজিং কার্যত 'পূর্ণ অভিভাবক' ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
ভারত যখন পাকিস্তানসংক্রান্ত নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যস্ত, তখন চীন সীমান্তে একতরফাভাবে পরিস্থিতি পাল্টাতে তৎপর হয়। ২০২০ সালে গালওয়ান উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এবং সাম্প্রতিক সময়ে অরুণাচল প্রদেশকে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার পদক্ষেপ তার উদাহরণ।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) অনিল মহন বলেন: “দ্বিমুখী চাপ সৃষ্টি করে চীন ভারতের কৌশলগত প্রস্তুতিকে ছত্রভঙ্গ করতে চায়। একদিকে পাকিস্তান, অন্যদিকে লাদাখ—এই দুই ফ্রন্টে ভারতকে ব্যস্ত রাখাই তাদের লক্ষ্য।”
ভারতের চিরবৈরী প্রতিবেশীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব যত দীর্ঘস্থায়ী হয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের 'স্থিতিশীল আঞ্চলিক শক্তি' হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করা ততই কঠিন হয়ে পড়ে। এই শূন্যস্থানে চীন নিজেকে “শান্তিপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী” এবং “অর্থনৈতিক বিকল্প শক্তি” হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়—বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর কাছে, যেমন নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ।
পাকিস্তানের সামরিক রসদের বড় অংশই চীন থেকে আমদানি করা। ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা বাড়ার ফলে পাকিস্তান ক্রমাগত উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিকায়নের দিকেই ঝুঁকছে, যার ফলে চীনা প্রতিরক্ষা শিল্প লাভবান হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার অস্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি এই ত্রিমাত্রিক প্রতিযোগিতা—যেখানে চীন "নীরব বিজয়ী" হিসেবে এগিয়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক শক্তিও এই অস্থিরতা পর্যবেক্ষণ করছে উদ্বেগের সঙ্গে, কেননা এটি ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তা কাঠামোকে পুনর্গঠন করতে বাধ্য করছে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শ্যাম শরণ বলেন, “ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব কেবল দ্বিপাক্ষিক নয়—এটি এখন একটি বহুমাত্রিক ভূরাজনৈতিক খেলা, যেখানে চীন তার জাতীয় স্বার্থ অত্যন্ত সুচারুভাবে সুরক্ষিত রাখছে।”